
হেডলাইনটা বিতর্কিত মনে হচ্ছে? ভাবছেন নজর কাড়ার জন্য লিখেছি?
নাহ তা নয়, আমার উদ্দেশ্য পাঠকের দৃষ্টি নাকের ডগা ছাড়িয়ে আরো দূরে প্রসারিত করা, আর ব্লগ দুনিয়ার অলিগলি ভালো করে মেলে ধরা। সে চেষ্টাই করছি এই লেখাতে।
যারা কোনোদিন ব্লগ লেখেননি, বা হয়ত সবে শুরু করেছেন আর তারপর কোনো থৈ পাচ্ছেন না, এই লেখা পড়ে তাদের মোটামুটি একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে আশা রাখি।
প্রথমেই, কোরা (Quora) থেকে কিছু প্রশ্ন নিচে দিলাম, এগুলো প্রায়ই অনেকে জিজ্ঞাসা করেন।
- কীভাবে ব্লগ লিখে টাকা উপার্জন করা সম্ভব? বাংলায় ব্লগ লিখলে কি পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা উপার্জন করা সম্ভব হবে?
- নিজের একটি ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট অথবা ব্লগ বানানোর জন্য আপনার সেরা পরামর্শগুলি কী কী?
- নিজের ব্লগ বা ওয়েবসাইট শুরু করার আগে লেখা-লেখি করার জন্য Quora কি সবথেকে ভালো প্ল্যাটফর্ম?
- বাংলায় কতগুলো জনপ্রিয় ব্লগ সাইট আছে? আপনার মতে বাংলায় লেখা ব্লগ কি ভবিষ্যতে আরো জনপ্রিয় হতে পারে?
- ব্লগ কী? আমি কিভাবে একটি ব্লগ শুরু করতে পারি?
- কীভাবে আমি লেখালেখি করে টাকা উপার্জন শুরু করতে পারি?
- বিনামূল্যে কোন ব্লগ কীভাবে খুলতে পারি? ব্লগটি অবশ্যই সবসময় ব্যবহার করা যায় এমন হতে হবে।
- সম্প্রতি আপনার লেখা একটি ব্লগ আমাদের সাথে ভাগাভাগি করবেন কি?
- সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ব্লগ সাইট কোনটি?
- ব্লগ থেকে প্রথম কখন আয় শুরু হয়?
লক্ষ্য করুন, দশটার মধ্যে তিনটি প্রশ্ন ব্লগ থেকে অর্থ আয়ের ব্যাপারে, আর বাকিগুলো মোটামুটি ব্লগ শুরু কিভাবে করা যায় সে নিয়ে।
তো চলুন, ব্যাপারগুলো একটু বিশদে দেখা যাক। আপাততঃ পাঁচটা প্রধান বিষয়ে রেখাপাত করি।
(এক) আপনার এলেম কত সেটা জানুন
আমার মনে হয়, যে কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ থেকে অর্থ উপার্জনের প্রধানতঃ তিনটি ধাপ আছে।
১) কি ভাবে শুরু করবেন,
২) কি ভাবে সৃষ্টি করবেন, এবং
৩) কি ভাবে বিক্রি করবেন।
এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, কারণ আপনি যা সৃষ্টি করবেন সেটা মানুষ গ্রহণ না করলে পরের ধাপ অর্থাৎ অর্থ উপার্জন কেবল স্বপ্নই থেকে যাবে।ভিন্ন জনে ভিন্ন কথা বলবেন, কিন্তু অন্ততঃ বছর ১৫ ধরে ব্লগ লেখার সুবাদে সার কথা বুঝেছি যে আপনার লেখায় একটু অন্যরকম (ক) জানার, (খ) শেখার, বা (গ) মনোরঞ্জনের কিছু না থাকলে টাকাপয়সা কামানো সম্ভব নয়।
সুক্ষভাবে যেটা এখানে অনুচ্চারিত, সেটা হচ্ছে আপনাকে প্রথমে প্রমাণ রাখতে হবে যে আপনি আপনার লেখা দিয়ে কিছু জানাতে, শেখাতে বা মনোরঞ্জন করতে পারেন। এবং বিষয়টা ওটাই হওয়া বাঞ্ছনীয় যেটা পাঠকেরা একান্তভাবে চান।
যেমন ধরুন এই প্রবন্ধে আমি যেটা লেখার চেষ্টা করছি সেটা আপনারা অনেকেই জানতে চান।
(দুই) ডোন্ট পুট দ্য কার্ট বিফোর দ্য হর্স
এটা একটা বহু চর্চিত ইংরেজি প্রবচন।
মানেটা সহজ। ঘোড়াই গাড়ি টানে, উল্টোটা কখনোই হয় না।
বরং সেটা করতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু না।
অন্যভাবে বললে, অধিকাংশ কাজের একটা পদ্ধতি আছে, সেটা বুঝে এগোনোই বিবেচনাবোধের পরিচয়।
পদ্ধতি ছাড়া যে বাজিমাৎ করা যায় না তা নয়, কিন্তু সেটা তারাই করতে পারে যাদের বাজারে প্রচুর পরিচিতি আছে, বা তারা কোনো কারণে এক বা একাধিক শক্তিশালী ইন্টারেস্ট-গোষ্ঠীর সাপোর্ট পাচ্ছে।
ব্লগের ক্ষেত্রে যেটা সর্বাগ্রে দরকার সেটা হলো লেখার মাধ্যমে নিজের পরিচিতি বাড়ানো।
অনেকে ভাবেন নিজের ব্লগ শুরু করবেন, উপরের প্রশ্নগুলোতে তো অন্ততঃ তাই প্রকাশ পায়।
কিন্তু মজার কথা এই যে শুরুর দিকে নিজস্ব ব্লগ থাকা একেবারেই জরুরি নয়। পরিবর্তে অন্য ব্লগে লিখুন, যেমন Quora, এই-সময়, ইত্যাদি।
আপনার লেখা সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন। অন্যরা পড়ুক, সমালোচনা করুক। এর ফলে ধীরে ধীরে আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন।
দু’ চার মাস গেলে বুঝতে পারবেন কোন বিষয়ে আপনার পারদর্শিতা বেশি, কোন ব্যাপারে লিখতে আপনার বেশি ভালো লাগে।
(তিন) যত পড়বেন তত লিখবেন
এটা কোনো লিমেরিক নয়, বরঞ্চ এক কঠিন বাস্তবের প্রতিচ্ছবি।
প্রসিদ্ধ মার্কিন লেখক স্টিফেন কিং বলেছেন –
“If you don’t have time to read, you don’t have the time (or the tools) to write.”
কথাগুলোর বাংলায় তর্জমা এইরকম –
“আপনার যদি পড়ার সময় না থাকে তবে আপনার কাছে লেখার সময় (বা সরঞ্জাম) কখনোই থাকবে না।”
স্টিফেন কিং-এর কথাগুলো পড়লে সেই আগের দিনের গমকল মনে পরে। যত গম ঢালা হবে তত আটা বেরোবে।
লেখার ব্যাপারটা ঠিক এরকমই। যত পড়বেন ততই মনের মধ্যে গজিয়ে উঠবে নতুন নতুন লেখার রসদ।
আর যদি চান বিরামহীন গল্পের প্রবাহ, তাহলে ম্যাথিউ ডিক্স-এর স্টোরিওয়ার্দী – Storyworthy by Matthew Dicks – বইটি পড়তে ভুলবেন না (পেপারব্যাক সংস্করণ)। এতে লেখক ভারি সুন্দর উদাহরণ দিয়ে অফুরন্ত গল্প লেখার কায়দা ব্যাখ্যা করেছেন।
আরেকটা কথা। যদি কোনোদিনও না লিখে থাকেন তাও লিখতে পারার অব্যর্থ ফর্মুলাগুলো শিখে যাবেন এই বইয়ে।
পড়ার গুন যে কত তার একটা সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন বিশ্বখ্যাত ইনভেস্টর ওয়ারেন বুফে (Warren Buffet)। স্মার্ট কি ভাবে হবেন সে বিষয়ে একবার উনি বলেছিলেন, “পড়ুন, প্রচুর পড়ুন।”
ব্যাখ্যাস্বরূপ আরও বলেছিলেন, “আমি সারাদিন অফিসে বসে শুধু পড়ি।” ওনার হিসেব অনুযায়ী দিনের ৮০% কেটে যায় পড়তে আর ভাবতে।
তাহলেই দেখুন পড়ার গুন কতটা ইতিবাচক, কতটা প্রভাবশালী হতে পারে আপনার জন্য।
(চার) যত লিখবেন তত লিখবেন
এতো গেল লিখতে পারার একটা দিক – যত পড়বেন তত লিখবেন।
অন্যটা হলো যত লিখবেন তত লিখবেন।
এ বিষয়ে এক প্রখ্যাত লেখিকার কথা উল্লেখ করছি। একটি মেয়ের লেখার ব্যাপারে ওনার মাকে বলেছিলেন –
আসলে ওকে অনেক লিখতে হবে। মানে, এটাই আসল কাজ। ও অনেক লিখুক। সত্যি বলতে কি, এছাড়া কোনো যাদু কৌশল নেই, কোনো সহজ সমাধান নেই, কোনো দ্রুত সাফল্যের স্কিম নেই।
যদি এখনও মনে সংশয় থাকে, নিচের ছবিটা দেখে আশা করি কেটে যাবে। এই স্মরণীয় ছবিটা ব্রায়ান ক্লার্কের কপিব্লগার ওয়েবসাইট থেকে নেয়া।

এ পর্যন্ত পরে হয়তো ভাবছেন অর্থ উপার্জনের ব্যাপারটা বোধহয় পাশ কাটিয়ে গেলাম। চিন্তার কারণ নেই, এটাই এখন লিখবো।
(পাঁচ) সি-টি-পি-এমই (c-t-p-m) ব্লগ থেকে উপার্জনের একমাত্র উপায়
নিচের ছবিটা ভালো করে দেখুন।
সি-টি-পি-এম ফর্মুলা কানাডা-স্থিত ওয়েবসাইট সাইটসেল-এর প্রতিষ্ঠাতা কেন এভয়-র মস্তিকপ্রসূত।
১৯৯৭ থেকে শুরু করে বিগত প্রায় ২৩ বছরে সাইটসেল-এর ১৩০,০০০ এরও অধিক গ্রাহক আছে সারা দুনিয়ায়।

কেন-এর ফর্মুলাটা বেশ সোজাসাপ্টা।
কনটেন্ট, মানে আপনার লেখন, আর মনিটাইজেশন্ (monetization) বা অর্থ উপার্জন একটা লম্বা টানেলের মত।
এই প্রসঙ্গে একটা ছোট ব্যাপার জানিয়ে রাখা ভালো।
আজকের দিনে কনটেন্ট মানে শুধু লেখা নয় – ভিডিও, ছবি, পডকাস্ট, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ইত্যাদিও কন্টেন্টের আওতায় পড়ে।
তো ফিরে আসি আগের কথায়।
লেখা শুরু করলেই আয় শুরু হবে এমনটা কখনোই হয় না (এটা উপরে উল্লেখ করেছি)। এই দুইয়ের মধ্যিখানে দু’টো ইন্টেরিম বা অন্তর্বর্তী ধাপ আছে – ১) ট্রাফিক, আর ২) প্রি-সেল।
সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে ট্রাফিক।
আপনাকে ভাবতে হবে কি ভাবে আপনার লেখা সর্বাধিক মানুষের নজরে আসে।
ভালো লেখা যেমন দরকার, তেমনি যত বেশি মানুষ আপনার লেখা পড়বে ততই আপনার পরিচিতি বাড়বে, ততই বাড়বে আগ্রহ আপনাকে জানার ও চেনার।
এ জিনিস একদিনে হয় না, আবার আগের মত বহুদিনও লাগে না।
কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার বলা যায় – যে ওয়েবসাইটে অলরেডি অনেক ট্রাফিক আসে, সেখানেই লেখা শুরু করাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
অর্থাৎ, ব্লগ নিয়ে নিজের ঘর-দোরের স্বপ্ন পরে, তার আগে প্রয়োজন নিজেকে সু-প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা একবার করতে পারলে দেখবেন ব্লগ শুরু করাটা কোনো ব্যাপার না, অনায়াসে হয়ে যাবে।পরিশেষে সার কথাটা বলি – ব্লগ কিন্তু আপনাকে অর্থ দেবে না। আপনার উপার্জন হবে আপনার জ্ঞান ও আপনার পরিচিতি থেকে।
তাহলে, আজ এ পর্যন্তই।
এই লেখা ভালো লাগলে (বা যদি ভালো নাও লাগে) নিচে কমেন্ট লিখতে ভুলবেন না।
আর সময় পেলে আমার ইউটিউব ভিডিওগুলোও নিশ্চয়ই দেখবেন (অনেক টেকনিক্যাল টিপস দিই ভিডিওগুলোতে)।
নমস্কার।
Leave a Reply